বাসার মালিক কোন কিছু জিজ্ঞাসা না করেই অল্প টাকায় বাসা তাদেরকে ভাড়া দিয়ে দিল। রাশেদ ও মল্লিকা এই বাসাতেই তাদের দাম্পত্য জীবনের সূচনা করলো। একদিন মল্লিকা বাসার ছাদে গুদাম ঘরে পরিত্যক্ত কিছু জিনিশের মধ্যে একটি পুরনো আয়না খোঁজে পেল। এটি অনেক পুরনো মাঝারি সাইজের একটি আয়না। আয়নার চারিদিকে স্ট্রিলের ফ্রেমে অসম্ভব সুন্দর কারুকাজ। আয়নাটি তাই মল্লিকার পছন্দ হল। মল্লিকা গুদাম ঘর থেকে আয়নাটি বের করে তাদের শোবার কক্ষের দেয়ালে টাঙ্গিয়ে রাখলো। আয়নাটি কক্ষের সুন্দর্য্য দ্বিগুণ বাড়িয়ে তুললো।
এইভাবে কিছু দিন যাবার পর একদিন মল্লিকা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার চোখে কাজল দিচ্ছে। তখন সে আয়নাতে একজন মহিলার প্রতিচ্ছবি দেখতে পেল। মহিলাটি আয়নার সামনে দরজার পিছনে পর্দার পিছে শুধু মাথা বের করে দাঁড়িয়ে আছে। মল্লিকা আচমকা আয়নায় মহিলাটির প্রতিচ্ছবি দেখে জিজ্ঞাসা করলো- কে, কে ঐখানে। কিন্তু কোন উত্তর আসলো না। সে সাড়া বাসায় মহিলাটিকে খোঁজলো। কিন্তু মহিলাটিকে পেলো না। মল্লিকা ভাবলো হয়ত সেটা ছিল তার চোখের ভুল অথবা মনের ভ্রম। তাই সে ঘটনাটিকে তেমন প্রশ্রয় দিল না এবং রাশেদের কাছে বিষয়টি গোপন রাখলো। তারপর হতে যখন-তখন মল্লিকা সেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। মল্লিকা ঘন্টার পর ঘন্টা আয়নাতে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে কাটিয়ে দেয়। ব্যাপারটা রাশেদ প্রথম দিকে তেমন গুরুত্ব দিল না। সে ভাবলো মেয়েরা আয়নায় নিজের রূপ দেখতে ভালবাসে তাই হয়ত সাড়া দিন আয়নায় তাকিয়ে থাকে।
কিন্তু একদিন রাশেদ বাহিরের কাজ শেষ করে বাসায় ফিরেছে। সে ভীষণ ক্লান্ত। তারমধ্যে বাসায় বিদুৎ নেই, লোডশেডিং হয়েছে। সে মল্লিকা-কে পাখা দিয়ে একটু বাতাস করে দেয়ার জন্য বললো। মল্লিকা তখনো একদৃষ্টিতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রাশেদ ভাবলো মল্লিকা তার কথা শুনে না শুনার ভান ধরেছে। তাই সে মল্লিকা-কে পাখা দিয়ে একটু বাতাস দেয়ার জন্য আবার বললো। কিন্তু মল্লিকা একদৃষ্টিতে আয়নায় তাকিয়ে আছে।
এতে রাশেদ ক্ষেপে গেল। সে রাগে আয়নাটি আছাড় মেরে ভেঙ্গে ফেলে। সে মল্লিকার দিকে রাগান্বিতভাবে থাকালো। কিন্তু মল্লিকা-কে দেখে সে নিজেই অবাক হয়ে গেল। সে মল্লিকার চোখে অশ্রু হয়ে রক্ত বেরিয়ে আসতে দেখলো। এবং মল্লিকা বিড়বিড় করে কি যেন উচ্চারণ করতে লাগলো। তারপরই মল্লিকা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। রাদেশ কিছুতেই মল্লিকা শান্ত করতে পারেনা। সে মল্লিকার অস্বাভাবিক আচরণে হতভম্ব হয়ে পরলো। মল্লিকার এই দুর্দশায় সে কি করবে ভেবে না পেয়ে তার ডাক্তার বন্ধু মারুফকে ফোন করলো। মারুফ আসে সে নিজেও হতভম্ব হয়ে গেলে। মল্লিকা মাটিতে গড়াগড়ি দিয়েই চলছে। এইভাবে মাস খানেক পাড় হল। কোন ডাক্তারি চিকিৎসায় লাভ হচ্ছেনা।
একদিন মারুফ একজন তান্ত্রিক রাশেদের কাছে নিয়ে এল, সে ভাবলো হতে পারে সেটা জ্বীন-ভূতের আছড়। মারুফ তান্ত্রিক নিয়ে আসায় রাশেদ অবাক হল কারণ মারুফ মেডিকেল সাইন্স নিয়ে পড়ালেখা করেছে, সে নিজেই একজন ইন্টারি ডাক্তার। অথচ সে জ্বীন-ভূতে বিশ্বাসী। মারুফ রাশেদের মনের কথা আঁচ করতে পারলো। সে রাশেদকে বললো সে জ্বীন-ভূতে বিশ্বাস করেনা, কিন্তু তান্ত্রিকেরা বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী তাদের কাছে হয়ত এই সমস্যার সমাধান রয়েছে।
অতঃপর তান্ত্রিকের সামনে মল্লিকা-কে নিয়ে আসা হল। তান্ত্রিক শুধু মল্লিকার চোখের দিকে থাকালেন এবং চোখের কালো মনিতে একটা মহিলার প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলেন। রাশেদ ও মারুফ চমকে গেল। তান্ত্রিক বললেন তিনি পরিষ্কারভাবে দেখেছেন মল্লিকার চোখেতে একটি মহিলার প্রতিচ্ছবি। কিন্তু মল্লিকার সামনে কোন মহিলা নেই।
তান্ত্রিক রাশেদের কাছে জানতে চাইলেন মল্লিকার এইরকম আচরণে পিছনে কারণ কি। রাশেদ সবকিছু খোলে বললো, মল্লিকা সাড়া দিন একটি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো, একদিন রাগে সে আয়নাটি ভেঙ্গে ফেলে তারপর থেকেই মল্লিকার এই দূর্দশা। তারপর তান্ত্রিক জানতে চাইলেন আয়নাটি মল্লিকা কোথায় পেয়েছে। রাশেদ বললো বাসার ছাদে গুদাম ঘরে আয়নাটি ছিল, গুদাম ঘরে আরো কিছু পুরনো জিনিশ আছে, এইসব জিনিশ তাদের বাসার মালিকের, আয়নাটিও বাসার মালিকের।
তান্ত্রিক বাসার মালিকের সাথে সাক্ষাত করতে চাইলেন। তান্ত্রিকের সামনে বাসার মালিক কে আনা হল। তিনি আয়নাটি কোথায় পেয়েছিলেন আর আয়নাটি গুদাম ঘরে রাখার আগে কোথায় ছিল সেটা জানতে চাইলেন। বাসার মালিক বললেন আয়নাটি উনি উনার বিয়ের পর উনার স্ত্রীকে উপহার দিয়েছিলেন, আয়নাটি উনার স্ত্রীর খুব প্রিয় ছিল। কিন্তু উনার স্ত্রীর মৃত্যুর পর উনি পুরনো জিনিশের সাথে আয়নাটি গুদামে রেখে দেন। মৃত্যু কি স্বাভাবিকভাবে হয়েছিল তান্ত্রিক জানতে চাইলেন। হ্যাঁ, মৃত্যু স্বাভাবিকভাবেই হয়েছিল বাসার মালিক উত্তরে বললেন, কিন্তু মৃত্যুর আগে উনি আয়নার দিকে থাকিয়ে উনার শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।
সবকিছু শোনার পর তান্ত্রিক রাদেশকে বললো মল্লিকার চোখে ঐ মহিলাটি অন্য কেউ নয়, তিনি হলেন বাসার মালিকের স্ত্রী। এটি বাসার মালিকের স্ত্রীর আত্মা। উনি মৃত্যুর আগে সেই আয়নার দিকে থাকিয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন যার ফলে উনার আত্মা শরীরের সাথে যোগসূত্র ছিন্ন করার পর সেই আয়নাতে ডুকে পরে। আয়নার একটা বিশেষ শক্তি রয়েছে যা শুধু জীবিত মানুষকে আকর্ষণ করে তা নয়, বরং জীবিত মানুষের পাশাপাশি আত্মাদের কেও আকর্ষণ করে। সে আকর্ষণের ফলে আত্মারা আয়নার ভেতরে ডুকে যায়। কিন্তু আয়নার ভেতরে ডুকার পর আত্মা কখনোই আয়নার ভেতর হতে বের হতে পারেনা। আত্মাকে আয়নাতেই বন্ধী হয়ে থাকতে হয়। অনেকে হয়ত ভাবতে পারেন আত্মা যখন আয়নাতে বন্ধী তখন আয়না ভেঙ্গে ফেললে বন্ধী আত্মা মুক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু না, আয়না ভেঙ্গে ফেললে বন্ধী আত্মা মুক্তি পায় না। বরং তখন আত্মা অশুভ শক্তিতে পরিণত হয়।
রাদেশ তখন তান্ত্রিকের কাছে মল্লিকার চোখে মহিলাটি কিভাবে আসলো তা জানতে চাইলো। তান্ত্রিক বললেন মল্লিকা নিশ্চয়ই যখন আয়নায় তাকাতো তখন ঐ মহিলাকে দেখতে পেত। যার ফলে মল্লিকা বারবার সেই আয়নার সামনে দাঁড়াতো। কিন্তু সে আয়নায় নিজেকে দেখার জন্য দাঁড়াতো না, কেবল ঐ মহিলাকে দেখার জন্য দাঁড়াতো। তার চোখ কেবল মহিলাটিকে দেখার জন্য তাকে আয়নার সম্মুকে তাকাতে বাধ্য করত। যার ফলে তার চোখের কালো মনিতে মহিলাটির আত্মার প্রতিচ্ছবি সৃষ্টি হয়। মহিলাটির আত্মার প্রতিচ্ছবি মল্লিকা চোখে রয়েছে এবং আত্মাটি তার মুক্তির দাবিতে মল্লিকার উপর অত্যাচার করে যাচ্ছে।
বাসার মালিক এর প্রতিকার জানতে চাইলেন, তান্ত্রিক বললো প্রথমে উনার স্ত্রীর আত্মার মুক্তি দিতে হবে, আত্মা মুক্তি পেলে মল্লিকা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। তান্ত্রিক রাশেদকে আয়নার ভাঙ্গা কাঁচের টুকরো যোগার করতে বললেন। আয়নার ভাঙ্গা টুকরোগুলো রাশেদ ঘরের ডাষ্টবিনে ফেলে রেখেছিল। সে ডাষ্টবিন থেকে আয়নার ভাঙ্গা টুকরোগুলো তান্ত্রিক-কে এনে দিল। তান্ত্রিক বাসার মালিক-কে উনার স্ত্রীর কবরস্থানে নিয়ে যাবার জন্য বললেন।
বাসার মালিক তান্ত্রিক, রাশেদ, মারুফ এবং মল্লিকাকে উনার স্ত্রীর কবরস্থানে দিয়ে গেলেন। মল্লিকাকে ঐ মহিলার কবরের সামনে আনা হল । তান্ত্রিক রাশেদ ও মারুফকে বললেন ওরা যেন মল্লিকাকে শক্ত করে ধরে রাখে যাতে মল্লিকা মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি না খায়। রাশেদ ও মারুফ মল্লিকাকে দুপাশে শক্ত করে ধরে রাখলো। তান্ত্রিক বাসায় মালিকের স্ত্রীর কবরের পাশে ছোট একটি গর্ত খুদলেন। অন্যদিকে মল্লিকার মধ্যে অস্থিরতা বেড়েই চলছে। তান্ত্রিক গর্তের ভেতরে আয়নার ভাঙ্গা কাঁচের টুকরোগুলোকে মাটি দিয়ে পুঁতে দিলেন এবং উচ্চস্বরে মন্ত্র পড়তে লাগেন। খানিকক্ষণ মন্ত্র পড়ার পর মল্লিকার মধ্যে অস্থিরতা কেঁটে উঠলো। কিন্তু মল্লিকা মহিলাটির কবরের দিকে তাকিয়ে অশ্রু ঝড়াচ্ছে। সে চিৎকার করে কাঁদছে। এইভাবে কাঁদার কিছুক্ষণ পর মল্লিকা অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। তান্ত্রিক তখন বললেন মল্লিকা অজ্ঞান হয়নি, সে এখন গভীর ঘুমে। অনেক দিন ধরে মল্লিকার শরীর ঘুমায় নি। মল্লিকার এখন অনেক ঘুমের প্রয়োজন। ঘুম শেষে সে তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।
বাসার মালিক তার স্ত্রীর আত্মা মুক্তি পেয়েছে কি না সে বিষয়ে তান্ত্রিকের কাছে জানতে চাইলেন। তান্ত্রিক তখন সবকিছু ভেঙ্গে বললেন। কবরের পাশে গর্ত করে ভাঙ্গা আয়নার টুকরো পুঁতে ফেলায় সেই আয়নার মধ্যে লুক্কায়িত শক্তি অচল হয়ে যায়। যার ফলে মহিলটির আত্মা শিথিল হয়ে পড়ে এবং মল্লিকা নিরব হয়ে কবরের দিকে তাকিয়ে কান্না শুরু করে। কিন্তু চোখ হতে অশ্রু মল্লিকার বের হয়নি, অশ্রু বের হয়েছে মৃত সেই মহিলার আত্মার। মল্লিকার চোখ ছিল আত্মাটির জন্য একটি মাধ্যম মাত্র। অশ্রু বের হওয়ার ফলে আত্মাটি শান্তি ফিরে পায়। এবং মুক্তির জন্য চোখ হতে বের হওয়া অশ্রুতে মল্লিকার চোখে আত্মাটির প্রতিচ্ছবি মিটে যায়। যায় ফলস্বরূপ আত্মা ও মল্লিকা উভয়ে মুক্তি পায়।
দু'ঘন্টা পর মল্লিকার ঘুম ভাঙ্গলো। তার সাথে কি কি ঘটেছিল তা কিছুই তার মনে নেই। সে এখন স্বাভাবিক। মল্লিকাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে পেয়ে রাশেদ মল্লিকাকে জড়িয়ে ধরলো। কিছু দিন পর বাসার মালিকের নির্দেশে তারা ঐ বাসাটি ত্যাগ করে। তারা তাদের পরিবারের কাছে ফিরে যায়। তাদের হিন্দু-মুসলিম পরিবার তাদের বিয়ে মেনে নেয়। তারা তাদের পরিবারের সাথে নিজেদের মতন করে তাদের সংসার সাজায়। আজ মল্লিকা ফুটফুটে এক কন্যা সন্তানের জননী কিন্তু সে আজো জানেনা ঐ আয়নাতে সে কি দেখেছিল।
(সমাপ্ত)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন