রবিবার, ২৯ জুন, ২০১৪

গল্প "মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১"

এলোপাতাড়িভাবে চারিদিকে বৃষ্টির মতন গুলি ছড়িয়ে পরছে। বাসাতে গোলা-বারুদের গন্ধ। নিরস্ত্র বাঙ্গালীর হাহাকার চতুর্দিকে। সেই সাথে পাক সেনারা ঘরে ঘরে টহল দিতে শুরু করেছে। প্রথম সারির কয়েক ঘরের পর-ই রোকেয়াদের ঘর। ঘরে রোকেয়া ও তার স্বামী অসহায়ের মত পড়ে আছে। রোকেয়ার স্বামী সিরাজের ডান পা ছোটবেলায় পোলিও-তে আক্রান্ত হওয়ায় কারণে সেটা অকেজো। তাকে লাটিতে ভর করে হাঁটতে হয়। ইতি মধ্যে পাক সেনারা রোকেয়ার ঘরে ডুকে পরছে। পাঁচ জন পাক সেনা। এদের মধ্যে একজন তাদের গ্রুপ লিডার।

সে সিরাজের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বাকি চার পাক সেনাকে নির্দেশ দিলো সিরাজকে বাহিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। ওরা টেনেহিঁচড়ে সিরাজকে ঘরের বাহিয়ে নিয়ে গেলো। ওরা সিরাজকে মাটিতে ফেলে মারতে শুরু করলো। সিরাজের পিঠে-পেটে কয়েক ডজন লাতি মারলো। অন্যদিকে ঘরের ভেতর পাক সেনার গ্রুপ লিডার টেনে খোলে ফেললো রোকেয়ার শরীর হতে শাড়ী। ধর্ষণ করলো রোকেয়াকে। একে একে পাঁচজন পাক সেনা রোকেয়াকে ধর্ষন করলো। সিরাজ শত চেষ্টা করেও পারলোনা রোকেয়ার ইজ্জত বাচাঁতে।

পাক সেনারা যাবার পূর্বে সিরাজকে গুলি করে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। গ্রুপ লিডার তখন বললো, ঠিক মতন নিজ পায়ে খাড়া হওয়ার ক্ষমতা ওর মধ্যে নাই। একে প্রাণে মারতে হবেনা, সে এমনেতেই তার ধর্ষিতা স্ত্রীর সাথে মরে যাবে। এই বলে পাক সেনারা তাদের ঘর থেকে চলে গেলো। আহত সিরাজ ধীরে ধীরে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে ডুকলো ঘরের ভেতর। ভেতরে ধর্ষিত নির্বাক রোকেয়ার রকাক্ত শরীর। সে বসে আছে সর্ব শান্ত হয়ে। সিরাজ ও রোকেয়া একে অন্যকে দেখে কাঁদতে শুরু করে।

পরবর্তীতে একদিন সিরাজ চলে যায় মুক্তিসেনাদের দলে। যাবার আগে সে রোকেয়াকে কথা দিয়েছিল এই অন্যায় অত্যাচারের বদলা সে নিবেই। রোকেয়ার সম্মানহানির প্রতিশোধ তাকে নিতেই হবে। কিন্তু রোকেয়ার মনে ভয় ছিল, যে লোক নিজ পায়ে ঠিক মত দাঁড়াতে পারে না সে কিভাবে যুদ্ধ করবে। যুদ্ধ সিরাজের পক্ষে সহজ না। কিন্তু শারীরিক দুর্বলতাকে তোয়াক্কা না করে সিরাজ যুদ্ধে গেছে সেটাই ছিল রোকেয়ার জন্য গর্বের বিষয়।

সিরাজ চলে যাবার পর অসহায় রোকেয়া পথ চেয়ে থাকতো। সে অপেক্ষা করতো কবে সিরাজ ফিরে আসবে বিজয়ের পতাকা হাতে নিয়ে। অবশেষে দেশ স্বাধীন হল। স্বাধীন হবার কিছু দিন পর রোকেয়ার কাছে একটি চিঠি আসলো। চিঠিতে লেখা ছিল:

প্রিয়তমা রোকেয়া,

অনেক দিন তোমাকে দেখি না। তোমাকে দেখতে অনেক ইচ্ছে করে। কিন্তু কিভাবে আমি তোমার সামনে দাঁড়াবো। তোমার সামনে দাঁড়ানোর মুখ আমার নেই। স্বামী হয়ে আমি পারলাম না তোমাকে শ্লীলতাহানি হতে রক্ষা করতে। সে ভয়ংকর দৃশ্যটি আজো আমার চোখে ভাসে। চোখে বন্ধ করলেই আমার চোখে ভেসে উঠে তোমার মলিন মুখ। কর্ণপাত করি তোমার চিৎকার। তোমাকে কথা দিয়েছিলাম তোমার সাথে যে অন্যায় হয়েছে সে অন্যায়ের উচিত বিচার আমি করবোই। যার জন্যে এই যুদ্ধতে আমার আসা। আমার পায়ের কারণে আমার অন্য মুক্তিসেনা ভাইরা আমাকে সরাসরি যুদ্ধে যেতে দেয় না। যদিও ভারি অস্ত্র হাতে নিয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা আমার নেই। আমি তাই আহত মুক্তি ভাইদের দেখাশোনা করি। ওদের সেবা করে সুস্থ করে তুলি। কিন্তু রোকেয়া আজ আমি বিড়াট সুযোগ পেয়েছি। আজ আমি সরাসরি যুদ্ধে যাবো। আমার শরীরে এখন আত্মগাতী বোমা লাগানো। আমার সামনে মানুষ রূপি পাকিস্তানি কুকুরদের ক্যাম্প। একটু পর ওরা রাতের খাবার সেরে বিশ্রাম নেবে। আমি তখনি ডুকে পরবো ওদের ক্যাম্পে। সেখানে যে তাবুতে গোলা-বারুদ রাখা সে তাবুতে আমি ডুকে বিড়াট বিষ্ফোরন ঘটাবো। এক নিমিষেই সমস্ত ক্যাম্প ধূলোয় মিশে যাবে। সাথে মিশে যাব আমিও। জানি না কবে আমার এই চিঠি তোমার হাতে পৌঁছবে। যখন পৌঁছবে তখন আমি থাকবো না স্বাধীন এই দেশে। কিন্তু এই ভেবে আমার বিন্দু পরিমাণ কষ্ট হচ্ছে না। বরং আমি গর্বিত তোমাকে একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিতে পারবো তুমিসহ হাজারো মা-বোনের সম্মানের বিনিময়ে।

ইতি,
তোমার সিরাজ।

(সমাপ্ত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন